রাজনীতি এখন কোন পথে তা বলার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কথা লিখে কলামের পাতা পূর্ণ করা যায়। তবে প্রাসঙ্গিকতার কারণে বামপন্থি দলগুলোর ‘উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলার আগুনের মধ্যে পড়ার তত্ত্ব সম্পর্কে দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন। কমিউনিস্ট পার্টিসহ প্রগতিশীল বাম রাজনীতি যারা করেন তাদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ইতিবাচক। এটাই তাদের একমাত্র সম্বল। এটাকে অবলম্বন করে তারা এখন পত্রিকায় কলাম লিখেন আর টেলিভিশনের টকশোতে যোগ দেন। জনমানুষের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ভোটে দাঁড়ালে সব জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। স্বাধীনতার পর গত ৪৪ বছরের খতিয়ানে দেশের জন্য তাদের অবদান দুরবিন দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কথায় বামরা জামায়াতের বিনাশ চাইলেও নিজামী, মুজাহিদের মতো গণহত্যাকারীদের যারা মন্ত্রী বানায় সেই বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগকে যখন একই পাল্লায় মাপা হয় তখন প্রকারান্তরে জামায়াতের পক্ষই অবলম্বন করা হয়। এতে জামায়াতের আয়ু বাড়ে এ কথা তারা বেমালুম কেন ভুলে যান মানুষ তা বুঝতে পারে না। বামরা ভুলে যান যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট পুনরায় ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ এতদিনে আরেকটি পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা ইরাক হতো। বাম নেতাদের পত্রিকায় কলাম লেখা এবং টেলিভিশনের টকশোতে কথা বলা তো দূরের কথা, মাটির ওপরে তাদের অবস্থান থাকত কিনা সেটাই সন্দেহ। নিজেদের ভুল রাজনীতির কারণেই তারা আজ জনবিচ্ছিন্ন এবং অস্তিত্বহীন। সুতরাং বলা যায় রাজনীতির পথ নির্ধারণে বামদের ভূমিকা এখন জিরো।
বিএনপি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে এই দলের জন্ম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সামরিক শাসকদের হাতে জন্ম নেওয়া সব রাজনৈতিক দল ওই নির্দিষ্ট সামরিক শাসকের মৃত্যুর পর আর টিকে থাকেনি। পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, চিলি, থাইল্যান্ড, মিসর, ইরাক, লিবিয়িা সর্বত্রই একই উদাহরণ। তাই বিএনপির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তারা আজ অবধি ৩৫ বছর টিকে আছে। শুধু টিকে থাকা নয়, গত শতকের নব্বই দশকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত পূর্ণ দুই মেয়াদে তারা ১০ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছে। তবে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতা, উগ্র ধর্মান্ধদের সঙ্গে অতিরিক্ত মাখামাখি এবং তার রেশ ধরে দেশের অভ্যন্তরে উগ্র জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ উত্থান এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হারার পর থেকে এ পর্যন্ত একের পর এক ভুল ও হঠকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে ২০১৫ সালে এসে বিএনপি এখন একেবারে দিশাহীন হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে লজ্জাজনক দেউলিয়াত্বের পরিচয় দিচ্ছে। সম্প্রতি নিজেদের অঙ্গসংগঠন ও জোটের দলগুলোর ইফতার পার্টিতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া যেভাবে বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন সেগুলো অনুষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষায় বেমানান। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ইফতার পার্টিতে এমনটি দেখা যায়নি। এর আগে অন্য বছরগুলোতে ইফতারের মতো একান্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়াকেও এমন পরচর্চা, পরনিন্দাসূচক আক্রমণাত্দক বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। পবিত্র ইফতারের আগ মুহূর্তে দোয়া কবুলের সময়ে এমন বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্যকে চরম অস্থিরতা এবং হতাশার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন মানুষ। বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা-কর্মীদের মধ্যে গোপন টেলি কথোপকথনের সারমর্ম ফাঁস হওয়ার পর যা শোনা গেছে তাতে দলের অভ্যন্তরের বিশৃঙ্খলা, নড়বড়ে অবস্থা ও হতাশাজনক অবস্থার কথা আর কাউকে বলতে হয় না, এমনিতেই সবাই বুঝতে পারে। বিএনপির পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের নামে মিথ্যা ও নকল বিবৃতি প্রচার, ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহের টেলিফোন করা সম্পর্কিত মিথ্যাচার দেখে মনে হয়েছে নিজেদের শক্তিতে বিএনপির আর বিশ্বাস নেই। তারপর গত বছর ঢাকায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করার জন্য একটা স্বাধীন দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যেভাবে হোটেলে ছুটে গেলেন এবং সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে নতজানু হয়ে যেসব নালিশ দিলেন তাতে দলের চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের চিত্রই ফুটে ওঠেছে। শোনা যাচ্ছে বিএনপি এখন সংগঠন গোছানোর দিকে নজর দেবে এবং নিবেদিত নেতা-কর্মীদের নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া দলকে পুনর্গঠন করবেন। এটা রাজনীতির জন্য ভালো খবর। তবে সেই পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় জামায়াতকে না ছাড়লে এবং ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ত্যাগ না করলে যেই লাউ সেই কদু স্টাইলের পুনর্গঠন করে বিএনপির কোনো লাভ হবে না। বিশ্বের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক সমীকরণের বাস্তবতায় বিএনপিকে বুঝতে হবে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির দিন শেষ। বিএনপির জন্য এখন একটি ক্রান্তিকাল এবং উপযুক্ত সময়ও বটে। তারা ইচ্ছা করলে জামায়াত ত্যাগ করে প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারে, আর নয়তো আগের পথেই পড়ে থাকতে পারে। আগের পথে থাকলে সামরিক শাসকদের গড়া দলের ঐতিহ্য ধরে অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারে, আর পুনর্গঠন করে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে ফিরে এলে আগামীতে আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম হতে পারে।
আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তম দল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় অর্জনসহ স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং বাংলাদেশের বড় বড় সব অর্জনে এই দলের একচ্ছত্র অবিস্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে। এ কারণেই এই দলের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি এবং একটুতেই এই দলের বিরুদ্ধে মানুষ কঠিন সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। তাদের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যর্থতা, যে কারণেই হোক তারা উগ্রবাদী ধর্মান্ধ রাজনীতির উত্থান ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। এ দায় তাদের ওপর বর্তাবে, কারণ বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই যাদের ওপর মানুষ এই বিষয়ে ভরসা রাখতে পারে। দুই মেয়াদে একনাগাড়ে প্রায় ছয় বছরের অধিক আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। বিরাজমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে সার্বিক তথ্য-উপাত্তসহ মূল্যায়ন করলে গত ছয় বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পারফরমেন্সকে অবশ্যই হাই রেটিংয়ে ফেলতে হবে। একনাগাড়ে গত ছয় বছর ধরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের সব সূচক ঊর্ধ্বমুখী আছে। যার ফলে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হলো। বিশাল ব্যাপার। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো এই উন্নয়নকে টেকসই করার জন্য, অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত ও ষড়যন্ত্রকারীদের দুরভিসন্ধি মোকাবিলা করার জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গত ছয় বছরে কতটুকু সুসংগঠিত হয়েছে? শোনা যায় বিএনপি-জামায়াতের লোক এখন আওয়ামী লীগে ঢুকছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতারা যেন মোশতাক ও শফিউল আলম প্রধানের কথা মনে রাখেন। এতদিনে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা কতটুকু রাজনৈতিক পরিপক্বতা, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা অর্জন করেছে সে সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক কোনো চিত্র দেখি না। বাজেট সেশন সদ্য শেষ হলো। দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তার জন্য বড় বড় যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেগুলোর মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে মন্ত্রী-এমপিদের বক্তৃতায় গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কোনো কথা শুনতে পেলাম না। একটি সরকারের ইতিবাচক অর্জনগুলোকে সুসংহত করার জন্য দলের তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের যে ভূমিকা থাকার কথা সেটি বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে তো নেই, বরং উল্টো ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মকাণ্ডে সরকারের বড় বড় অর্জন অনেক সময় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের যাত্রার শুরুতে বিডিআর হত্যাকাণ্ডসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব এবং সর্বশেষ ২০১৪-২০১৫-এর শুরুতে দুই দফায় বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত ধ্বংসযজ্ঞকে মোকাবিলা করে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা যেভাবে অব্যাহত আছে, তাতে বলা যায় এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এখন একেকটি এসিড টেস্টের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছেন। এই এসিড টেস্টে শেখ হাসিনার স্কোরিং ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী।
শেখ হাসিনা এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। তাই প্রখ্যাত কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন- শেখ হাসিনাকে এখন একটি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিতে হবে। সেই বিপ্লবে আওয়ামী লীগসহ দেশের রাজনীতি পরিশুদ্ধ হবে। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ হয়েই তবে রাজনীতি করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন সেই রাস্তায়ই চলছে বলে মনে করি। তবে পথ কণ্টকহীন নয়। পঁচাত্তরের শত্রুরা সক্রিয়। যাত্রীরা সবাই সাবধান ও সতর্ক থাকুন।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
sikder52@gmail.com
(ডেস্ক)