(দিনাজপুর২৪.কম) চলে গেলেন প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষাসৈনিক অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের এ পথিকৃত গতকাল বিকাল ৩টা ৪৮ মিনিটে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। তার বয়স ছিল ৮৪ বছর। ফুসফুসের সংক্রমণ ও অ্যাজমার সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে থাকা এই অধ্যাপকের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে গত ১৬ই মে তাকে ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গতকাল মাগরিবের নামাজের পর মমতাজউদদীন আহমদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় গুলশান আজাদ মসজিদে। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের বাসায়। আজ সকালে দ্বিতীয় জানাজা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে।
এরপর দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট গ্রামে। নাট্যজনের ভাগ্নে শাহরিয়ার মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামার ইচ্ছাতেই তার দাফন হবে শৈশব গ্রাম ভোলাহাটে।’ এদিকে মমতাজউদদীন আহমদের ছেলে তিতাস যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগেই দেশে এসেছেন বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে। ১৯৩৫ সালের ১৮ই জানুয়ারি মমতাজউদদীন আহমদের জন্ম মালদহে, যা বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত। দেশ বিভাগের পর তার পরিবার তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে চলে আসে। তার শৈশব কেটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলায়। এ নাট্যজনের মাতার নাম সখিনা বেগম এবং পিতার নাম কলিমউদদীন আহমদ। মমতাজউদদীন আহমদ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি মালদহ আইহো জুনিয়র স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৫১ সালে ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়ার সময়ই রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। রাজশাহীর তৎকালীন ছাত্রনেতা ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুর সান্নিধ্যে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে ভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগঠনে তিনি ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী সরকারি কলেজের মুসলিম হোস্টেলের ইট কাদামাটি দিয়ে যে শহীদ মিনার গড়ে উঠেছিল, তাতে মমতাজউদদীন আহমদও ভূমিকা রেখেছিলেন। তখন জেল খেটেছেন একাধিকবার। কর্মজীবনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি কলেজে ৩২ বছর বাংলা ভাষা সাহিত্য এবং বাংলা ও ইউরোপীয় নাট্য বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৭৬-৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৭-৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এক অঙ্কের নাটক লেখায় বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। তার লেখা নাটক ‘কী চাহ শঙ্খচিল’ এবং ‘রাজার অনুস্বারের পালা’ কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকাভুক্ত হয়েছিল। নাট্যচর্চায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৭ সালে একুশে পদক পান। এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। তার রচিত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নাট্যত্রয়ী’, ‘হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘জমিদার দর্পণ’, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’। নিয়মিত চিত্রনাট্য রচনা ছাড়াও তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত’, ‘বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত’, ‘নীলদর্পণ’ (সম্পাদনা), ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (সম্পাদনা)।