চালের দাম বৃদ্ধির কারণে বাজারে প্রায় সময়ই ক্রেতাদের মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। দাম বৃদ্ধির কারণ নিয়ে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা একে অন্যকে দোষারোপ করলেও প্রকৃত কারণ ভিন্ন। দাম বৃদ্ধির কারণে বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়ার কথা স্বীকার করছেন ক্ষুদ্র ও পাইকারি বিক্রেতারা। তবে এ দাম বৃদ্ধির কারণ নিয়ে পাইকারি বিক্রেতাদের সাথে একমত নয় খুচরা বিক্রেতারা। খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, বিভিন্ন কারণ আর অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়ায় পাইকারি বিক্রেতারা। মূলত ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তারা। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে গত সপ্তাহ থেকে চালের দাম প্রকার ভেদে কেজিতে ২-১ টাকার হেরফের দেখা যায়। চলতি বছরের বাজেট ঘোষণার আগেই প্রতি কেজি চালের দাম ২ থেকে তিন টাকা বেড়েছে। আরেক দফা বাড়ানো হয় বাজেট ঘোষণার পর। এই বৃদ্ধির ধারা দীর্ঘ এক মাসেও কমেনি। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে চালের বাজার ওঠা-নামা করছে। দেখা যায়, দেশের সবচেয়ে বৃহত্তর ধান-চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর। চিকন চাল বিশেষ করে মিনিকেট চালের জন্য বিখ্যাত কুষ্টিয়ার মোকাম। সেখানে পাঁচশতাধিক রাইসমিলে গড়ে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ৫শ থেকে এক হাজার ৮শ টন চাল উৎপাদন হয়। কুষ্টিয়ার চিকন চাল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপেও বাজার সৃষ্টি করেছে। এ মোকামের চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে চালের দাম ওঠা-নামা। তাই সবার দৃষ্টি থাকে ওই মোকামের দিকে। সাধারণ ব্যবসায়ী বা ছোট মানের রাইসমিল মালিকরা বলছেন, সারাদেশে ৫-৭ জন বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। কৃষকদের থেকে ধান কিনে নেওয়ার পর শুরু হয় তাদের কারসাজি। কি পরিমাণ চাল বাজারে ছাড়া হবে আর কোন চালে কত দাম নির্ধারণ করবে এটা তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। চালমিল মালিক আনোয়ার হোসেন, আব্দুল আউয়াল ও রশিদ মিয়া বলেন, বড় মিল মালিক বা সিন্ডিকেটরা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারা ক্রেতাদের সাথে সাধারণ মিল মালিকদের জিম্মি করে ব্যবসা করে। এছাড়া বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে কৃষক থেকে সব ধান এক সাথে তুলে নেয়। তার পর তাদের ইচ্ছা চরিতার্থ করে। অপরদিকে সাধারণ মিল মালিকদের ঋণ দিয়ে ব্যাংক তেমন একটা সহায়তা করে না। আবার ঋণ দিলেও তা পরিমাণে খুবই অল্প। সব সময় আমাদের নির্ভর করতে হয় বড় মিল মালিকদের ওপর। তারা যেমনটা করেন ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের দেখানো পথে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। চাল সিন্ডিকেটের অন্যতম নেতা কুষ্টিয়ার রশিদ এগ্রো ফুডের মালিক আব্দুর রশিদ সাধারণ ব্যবসায়ীদের কথা অস্বীকার করে বলেন, তাদের অভিযোগ মিথ্যা। আমদানি করা চালে দফায় দফায় শুল্ক আরোপের কারণে চালের দাম বৃদ্ধি পায়। রাজধানীর চকবাজার এলাকার পাইকারি চাল বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা যেসব বড় মিল মালিকদের থেকে চাল আমদানি করি তাদের থেকে চাহিদা মতো চাল পাচ্ছি না। চাহিদা মতো আমদানি করতে না পারায় চালের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। একাধিক চাল ব্যবসায়ী বলছেন, দেশের বড় বড় চাতালগুলোয় দাম মোটেও বাড়েনি। বরং বড় মিল মালিকরা চাল কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা চাতালগুলো থেকে তুলনামূলক কম দামে চাল কিনতে পারছে। চাতালগুলোয় চালের দাম কম হলে কেন চালের দাম বাড়ছে জানতে চাইলে তারা বলেন, চাতালে চালের দাম কম হলে কি হবে পাইকারি বাজারে দাম কমেনি। এখানেই বড় বড় মিল মালিক আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজি। চাল ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমি ছোটোখাটো ব্যবসায়ী। সীমিত লাভ করে সংসার চালাই। যা লাভ করার তা করছেন বড় বড় ব্যবসায়ী আর মিল মালিকরা। তবে এটা পরিষ্কার যে তাদের সিন্ডিকেটের কারণে চালের বাজার বৃদ্ধি পায়। বিশ্লেষকরা মনে করেছন, মজুতদার ব্যবসায়ীদের ওপর নরজদারি থাকায় রমজান মাসে চালের দাম কিছুটা কম থাকে। সরকার আন্তরিক হলে অস্থিতিশীল চালের বাজার সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার ধান-চাল মজুতদারদের সিন্ডিকেট ভাঙা। রমজান মাসে ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের বিশেষ নজরদারি থাকায় তারা ওই সময় চালের দাম না বাড়িয়ে ঈদের পরপরই বাড়িয়ে দেয়। তারা মনে করেন, মোটা অঙ্কের লাভ করছে বড় বড় মিল মালিক আর ব্যবসায়ীরা। খুচরা ব্যবসায়ী আর চাতালরা ওই ফল ভোগ করতে পারে না। বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, কারসাজিবাজদের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চাল আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে সর্বাগ্রে এবং তা যেকোনো মূল্যে। যাতে চালের বাজারে বড় ধরনের ঘাটতি না হয়। আর সেই সুযোগটা তারা কাজে লাগাতে না পারে। সামনে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। অশুভ শক্তি সব সময়ই সুযোগের সন্ধানে থাকে। নির্বাচনকে সামনে রেখে কাউকে এমন সুযোগ দেওয়া যাবে না। তাহলে সিন্ডিকেটরা আরও বেশি কারসাজি করার সুযোগ পাবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, চালের দাম বাড়ার বিষয়ে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমারা ব্যবসায়ী নেতাদের ডেকেছি। তাদের সাথে বসে একটা সমাধানে নিয়ে আসবো। এছাড়া শিগগিরিই বড় বড় আড়তে অভিযান চালানো হবে। -ডেস্ক
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Notify me of follow-up comments by email.
Notify me of new posts by email.