(দিনাজপুর২৪.কম) হাইকোর্টের রায়ের কারণে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল সম্ভব নয় বলে গত বৃহস্পতিবার সংসদে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতেই ফের কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। কোটার যৌক্তিক সংস্কার ও আটকদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানান, আমরা কোটার বাতিল চাইনি, চেয়েছি সংস্কার। প্রধানমন্ত্রী নিজের ইচ্ছাতেই কোটা বাতিল করেছেন। এখন রায়ের অজুহাতে এমন ঘোষণা দিতে পারেন না। আমরা এখন প্রজ্ঞাপন চাই। এছাড়া গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের নিয়ে দেওয়া বক্তব্যেরও প্রত্যাহার চান তারা। এ নিয়ে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর গত বৃহস্পতিবারের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানাই। নইলে ছাত্র সমাজ তাদের অধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করে নিবে। ছাত্রদের আন্দোলন যৌক্তিক বলেই প্রধানমন্ত্রী দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু এরপর এমন বক্তব্য ছাত্র সমাজ মেনে নেবে না বলে তারা জানান। সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহম্মাদ তারেক রহমান বলেন, আমাদের আন্দোলন চলছে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন চলছে। ছাত্র সমাজ তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার। যতই বাধা আসুক না কেন আমরা আমাদের অধিকার আদায়ে রাজপথেই থাকছি। তাছাড়া আন্দোলনের নেতাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে রেখেছে। আমরাও সব-সময় আতঙ্কে থাকি। আটকদের মুক্তি ও যৌক্তিক কোটা সংস্কার না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। তিনি বলেন, সরকার এখন হার্ড লাইনে আছে। আমরা রাজনৈতিক চাল বুঝি না। এরপরও সরকার আমাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১০ ও ১১ এপ্রিল এতো বড় আন্দোলন হবে সেটা আমরা কখনো ভাবিনি। ছাত্র সমাজ মনে করেছে তারা বৈষম্যের শিখার হচ্ছে, তাই তারা মাঠে নেমেছে। তাদের কেউ জোর করে নিয়ে আসেনি। এখনো যৌক্তিক এ আন্দোলনে ছাত্ররা মাঠে আছে। আমাদের কঠোর আন্দোলন চলছে। এছাড়া ভিসির বাসায় যারা হামলা করেছে তাদের ভিডিও ফুটেজ আছে, কিন্তু তারপরও সরকার আন্দোলনের নেতাদের মিথ্যা এ মামলায় ফাঁসাচ্ছে। এসব কিছুই সরকার পরিকল্পনা করে করছে। তিনি আরও বলেন, গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী কোটা নিয়ে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা মেনেই প্রজ্ঞাপন দিতে হবে এবং অন্যায়ভাবে আটকদের মুক্তি দিয়ে ছাত্রদের পড়ার টেবিলে ফেরত নেওয়ার দাবি জানান তিনি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের তুহিন খান বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন যৌক্তিক। এ আন্দোলন সরকার মেনে না নিলে শিক্ষার্থীরা আরও কঠোর আন্দোলনে যাবে। কোটা থাকলে মেধাবীরা বঞ্চিত হয়। এখন সময় এসেছে বিষয়টি ভেবে দেখার। কোটা আন্দোলনের জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, আমরা এখনো রাজপথে আছি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে তা দেশের বঞ্চিত ছাত্র সমাজ মেনে নেবে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সে সময় মেধাতালিকা ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে, ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করা হয়। তথ্য মতে, নিবন্ধিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই-আড়াই লাখ। যা সমগ্র জনসংখ্যার ০.১২ বা ০.১৫ শতাংশ। ০.১২ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটার পরিমাণ ৩০ শতাংশ। যা হাজারে রূপান্তর করলে দেখা যায়, এক হাজার জনতার মাঝে ১ থেকে ১.৫ (দেড়) জন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটার পরিমাণ ৩০০। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে। যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০, জেলাভিত্তিক কোটা ১০, নারীদের জন্য ১০, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা প্রথা বাতিল করে সে ব্যবস্থা পুর্নমূল্যায়ন করতে হাইকোর্টে গত ৩১ জানুয়ারি একটি রিট দায়ের করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ও দুই সাংবাদিক। আবেদনে তারা উল্লেখ করেন, সব মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা বিদ্যমান রয়েছে। এই কোটা পদ্ধতি সংবিধানের ১৯, ২৮, ২৯ ও ২৯/৩ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৫ মার্চ ২০১৮ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আবেদনে ভুল রয়েছে এই মর্মে রিট আবেদনটি খারিজ করে দেন। কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের ৫ দফা দাবি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও সরকারি চাকরি প্রত্যাশীরা তাদের ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও দেশের কয়েকটি স্থানে মানববন্ধন করেন। যা ২৫ ফেব্রুয়ারি পুনরায় সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করা হয়। এরপর ৪ মার্চ দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ৬ মার্চ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে জানানো হয়, আপাতত কোটা সংস্কার হচ্ছে না। তবে আদেশে উল্লেখ করা হয় যদি কোটায় প্রার্থী না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হবে। এরপর গত ৩০ জুন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতিকালে আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরুসহ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। এরপর গ্রেপ্তার হন আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানসহ ১০ জন নেতা। যাদের সবাইকে ভিসির বাসায় হামলা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এমন কার্যক্রম দেখে বুঝা যাচ্ছে হার্ড লাইনে যাচ্ছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা যাবে না বলে সংসদে বক্তব্য দিলে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
দাবিসমূহ : চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার ৫টি দাবি নিয়ে চাকরি প্রত্যাশীরা আন্দোলন করছেন। দাবিসমূহ হলো সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমান কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা। কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া। সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ। কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না রাখা। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা।
কোটা সংস্কার আন্দোলন : প্রবাসী শিক্ষার্থীদের বিবৃতি : ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে তুলতে কোটা সংস্কার একটি যৌক্তিক দাবি উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছেন প্রবাসী শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে এ আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২ জন শিক্ষার্থী এ বিবৃতি দিয়েছে। গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে তারা উল্লেখ করেন, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩০ জুন আন্দোলনকারীদের প্রেস কনফারেন্স করার কথা ছিল। কিন্তু এর পূূর্বমূহুর্তে, বিনা উস্কানিতে আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়কসহ আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে মারধর ও নির্যাতন করা হয়। এমনকী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া থেকেও প্রতিহত করা হয়। উল্লেখ্য, এ আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন এবং নেতাদের জোরপূর্বক তুলে নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। চলমান এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর কোনো কার্যকরি ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। অন্যদিকে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে। এমনকি নেতাদের রিমান্ডে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এবং অভিভাবকরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিপীড়িত হয়েছেন। এসব ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। প্রবাসী শিক্ষার্থীরা বলেন, দমন-পীড়নের এসব ঘটনা দিয়ে আমরা বহির্বিশ্বে পরিচিত হতে চাই না। এতে করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তথা বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রত্যেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে ক্যাম্পাসে দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা জরুরি। প্রবাসী শিক্ষার্থীরা সরকারকে চলমান অবস্থার দ্রুত যৌক্তিক সমাধানের আহ্বান জানিয়ে সকল আক্রান্ত শিক্ষার্থীর অবিলম্বে সুচিকিৎসা, গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রছাত্রীদের ছেড়ে দেওয়া এবং যারা এসব বর্বরোচিত হামলা করেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করেন। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিবৃতিদাতা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা হলেন- অনির্বাণ ইসলাম, ফয়সাল বিন তৌহিদ সিদ্দিকী, মেহজাবিন হোসেন, পারভেজ আলম, মো. তসলিম মাহমুদ প্রমুখ। -ডেস্ক
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Notify me of follow-up comments by email.
Notify me of new posts by email.