(দিনাজপুর২৪.কম) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ব্যাপক প্রাণহানিতে সমালোচনা হলেও এই অভিযান বন্ধ হবে না। বরং অভিযান আরও প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে। মাদককে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। বৃহস্পতিবার (২৪ মে) দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের সামনের পুলিশ বক্সে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মাদকবিরোধী কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে পুলিশের পক্ষ মাদকবিরোধী প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়। এতে লেখা ছিল, ‘মাদক পরিহার করুন, নিজে বাঁচুন, আগামী প্রজন্মকে বাঁচান।’ অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও, ঢাকার পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বিভিন্ন বাসে মাদকবিরোধী স্টিকার সেঁটে দেন। অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে মাদকের আগ্রাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করাই এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ ‘মাদক নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের এই ঢাকা মহানগরীতে কোনো স্থান নাই। তাদের বলতে চাই, মাদক নিয়ে কারো কোনো কথা শোনা হবে না।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, নিরাপত্তা বাহিনী আক্রান্ত হওয়ার পর বাধ্য হয়েই গুলি করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা রয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা বিভাগওয়ারি এ তালিকা নিয়ে অভিযান চলছে। মাদক বিক্রেতারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। মাদক নির্মূলের নামে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করতে যায়, তখন তারা গুলি ছোড়ে। আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এসময় দু-একটি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেকোনো মূল্যে মাদক ব্যবসা বন্ধের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে বলেছেন। মাদকের বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে তা দমন করছে- তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তারা বলছেন, দেশে ক্রমাগতই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে, এটা বড়ই উদ্বেগের বিষয়। মাদক ব্যবসায়ীসহ যেকোনও সন্ত্রাসীকে এভাবে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা মানবাধিকার লঙ্ঘন। যেকোনও অন্যায় অপরাধকে বিচারের আওতায় এনে তার শাস্তি দেওয়া উচিত। অথচ সেটা হচ্ছে না।’ অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তরুণ সমাজকে সর্বনাশা ধ্বংসের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার একটি ‘যুগান্তকারী পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এই অভিযানকে। তার দাবি, এই অভিযানে সারা দেশের মানুষ ‘খুশি’ হয়েছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে, তাদের নাম সতর্কতার সঙ্গে যাচাই বাছাই করা হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েক মাস ধরে পুলিশ ও র্যাবের সমন্বয়ে একটি তালিকা করেছি। সেই তালিকা অনুযায়ী একে একে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।’ মাদকের বিরুদ্ধে রাজনীতিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করারও আহ্বান জানান মন্ত্রী। মাদকের ভয়াবহতার বিষয়টিও তুলে ধরেন কামাল। তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন মাদকের নেশায় জড়িয়ে ঐশী কীভাবে তার মা-বাবাকে হত্যা করেছে। একটি পরিবারে যদি একটি মাদকসেবী থাকে তাহলে সে পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।’ সন্তান বা স্বজনদের বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতনতার ওপরও জোর দেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘খোঁজ রাখুন, আপনার সন্তানরা কোথায় কী করছে।’
এসময় ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, প্রথম রমজান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের চিরুনী অভিযান শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত বিপুল পরিমা। মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার সকল মাদক স্পট গুড়িয়ে দেওয়া হবে।
শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে জানিয়ে কমিশনার আরো বলেন, প্রত্যেককে ধরে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে। জনগণের সহযোগিতা নিয়ে পাড়া-মহল্লার মাদক স্পটগুলো গুড়িয়ে দেওয়া হবে। কারণ মাদক যে কোন অপরাধের চেয়ে ভয়াবহ।
যেভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান মাদকাসক্ত কিনা: দেশের গবেষকরা বলছেন, দেশে এখন প্রায় ৭০ লাখ মাদকসেবী রয়েছে, যাদের বেশিরভাগ তরুণ। এদের মধ্যে ১০ বছর থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত কয়েক সপ্তাহের অভিযানে এ ৪৪ জনের বেশি মাদকব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পরিবারের কোন সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে উঠলে অন্যরা সেটি কীভাবে বুঝবেন? দেশে এ ধরণের সমস্যায় চিকিৎসার কী ব্যবস্থা রয়েছে?
কী কী লক্ষণ দেখলে সতর্ক হওয়া উচিত?: দেশের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘মুক্তি’র প্রধান আলি আসকার কোরেশী বলছেন, ”কেউ মাদকাসক্ত হয়ে উঠলে একদম শুরুর দিকে বুঝা আসলে একটু শক্ত। তারপরেও বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে, যা দেখা গেলে সন্তানের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।””যদি দেখা যায় যে, সন্তানের আচার আচরণে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যে শান্তশিষ্ট ছেলেটা হঠাৎ করে অপরিচিতের মতো আচরণ করছে। ঘুমের প্যাটার্ন পাল্টে যাচ্ছে। আগে যে সকালে স্কুলে যেতো, এখন সে নানা অজুহাতে স্কুলে যেতে চাইছে না। বিভিন্ন অজুহাতে টাকা চাইছে যে, আজকে এটা কিনতে হবে, কাল অন্য কাজে টাকা লাগবে। তখন সতর্ক হতে হবে।” আরো কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মন-মেজাজের হঠাৎ পরিবর্তন, ঘুম থেকে উঠে মেজাজ খারাপ করা, খাওয়া-দাওয়ার দিকে নজর না থাকা বা অতিরিক্ত ঘুমানো, রাতে জেগে দিনে ঘুমানো, এ ধরণের প্রবণতা দেখা গেলে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। পরিবারের কোন সদস্য ঘন ঘন অতিরিক্ত টাকা দাবি করলে, প্রাইভেট বা স্কুলের খরচের নাম করে বারবার টাকা চাইলেও সতর্ক হতে হবে। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, এসব ক্ষেত্রে সন্তান কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মিশছে, আসলেই স্কুলে বা প্রাইভেটে যাচ্ছে কিনা, এসব অভিভাবকদের নজরদারি করতে হবে। স্কুলের বেতন থেকে শুরু করে প্রাইভেট টিউটরের বেতনও অভিভাবকদের নিজেদের দেয়া উচিত, কারণ অনেক সময় প্রাইভেট বা স্কুলের নাম করে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে তারা নেশা করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মিথ্যা বলা বেড়ে যাওয়া, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া বা অনেক সময় চুরির অভ্যাস তৈরি হওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। বন্ধুদের মধ্যে যদি মাদকাসক্ত কেউ থাকে, তাহলেও তার মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
মাদকাসক্ত বোঝা গেলে কী করণীয়?: ডা. আলী আসকর কোরেশী বলছেন, চিৎকার চেঁচামেচি বা মারধর না করে এক্ষেত্রে একটাই পদক্ষেপ, তাকে সরাসরি একজন মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া। মানসিক চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যাদের মাদকাসক্তি নিরাময়ে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। তাদের কাছে যেতে পারলে আরো ভালো। এক্ষেত্রে ওই চিকিৎসক রোগীকে বিশ্লেষণ করে তার চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করেন। মি. কোরেশী বলছেন, ছোটখাটো ক্ষেত্রে বা প্রথম দিকে হয়তো ওষুধ আর নিয়মিত ফলোআপে মাদকাসক্তি দূর করা যায়। কিন্তু এই আসক্তি পুরনো বা গভীর হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। তিনি জানান, দেশে মূলত দুই পদ্ধতিতে মাদকাসক্তির চিকিৎসা হয়। একটি হচ্ছে রিহ্যাব পদ্ধতি। সাধারণত হেরোইন, প্যাথেড্রিন, ফেন্সিডিল বা মরফিন আসক্তদের এ ধরণের পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে দুই থেকে তিন মাস রিহ্যাব সেন্টারে আটকে রাখা হয়। নিয়মিত নেশা করতে না পেরে একসময় রোগীর নেশার প্রবণতা কেটে যায়। পাশাপাশি মানসিক পরামর্শে তিনি আসক্তি কাটিয়ে ওঠেন।
মাদকাসক্তি নিরাময়ে খরচ: দেশের সরকারি হাসপাতাল গুলোয় মাদকাসক্তি নিরাময় একহাজার টাকার মধ্যেই পনেরো দিনের জন্য চিকিৎসা সম্ভব। এর মধ্যে থাকা ও খাওয়া অন্তর্ভুক্ত। তবে বেসরকারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিমাসের জন্য ২০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়ে থাকে। এর মধ্যে চিকিৎসা, ওষুধ, থাকা ও খাওয়া অন্তর্ভুক্ত। -ডেস্ক
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Notify me of follow-up comments by email.
Notify me of new posts by email.