(দিনাজপুর২৪.কম) ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুর খবর শিরোনামে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে শোকবার্তা আর স্তুতির ঢল নামে। আবেগের স্রোতধারা আসতে থাকে তুষারধসের মতো। মৃত্যুসংবাদের বিশালত্ব ছাড়াও এসব প্রতিক্রিয়া মানুষ নিজে কি হারালো তার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার লক্ষণ। মোহাম্মদ আলীর প্রশংসা করে শেষ করা যাবে না। এ জন্য পর্যাপ্ত শব্দ, অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাস- কোনোটাই নেই। আলীর মতো বিরাট কোনো ব্যক্তিত্ব যখন মারা যান, তখন অনুভূত হয় এক ধরনের শূন্যতা। কিন্তু এবারে, আমি নিজের ভেতরে তাকিয়ে হঠাৎ মনোযোগ আকর্ষণ করার চাহিদা বোধ করলাম। এটা কি? এই অনুভূতিটা কোথা থেকে আসছে? এর অর্থ কি? আমার জন্ম ১৯৫১ সালে। মোহাম্মদ আলী শতাব্দির ঠিক মাঝখানে। পুরো একটা শতাব্দি তার নামে নামকরণ করাটা কেন তার প্রাপ্য? বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাধর বিখ্যাত মানুষদের তালিকাটা দেখুন- যারা এর দাবি করতে পারে। তাদের অর্ধেক হলো- স্টালিন, হিটলার, মাওয়ের মতো গণহত্যাকারী বা যারা হিরোশিমা নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলেছিলেন। তারা কখনই ওই শতাব্দিকে নিরূপণ করতে পারেন না। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী, শিল্পী, কবি, ঔপন্যাসিক, অভিনয়শিল্পীও আছেন- যাদের প্রত্যেকের যথার্থ দাবি রয়েছে ওই শতাব্দির উল্লেখযোগ্য এক একটি দিককে নিরূপণ করার। পাবলো পিকাসো আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে দেখতে হয়। পড়া শিখিয়েছে জেমস জয়েস। ফ্যানন শিখিয়েছেন লড়াই করা। বিদ্রোহ করা শিখিয়েছেন চে গুয়েভারা। পরিবর্তন করার পন্থা বাতলে দিয়েছেন গান্ধী। কুরোসাওয়া দেখতে শিখিয়েছেন। কিন্তু তাদের কেউই এই পৃথিবীতে তারা যে আলো ছড়িয়েছেন তার বাইরে পদচারণা বিস্তার করেন নি। মোহাম্মদ আলী তাদের সকলকে ছাপিয়ে উচ্চস্থানে রয়েছেন। কেননা, তিনি আমাদের জন্মসূত্রে লব্ধ নিষ্পাপতার সংজ্ঞা আর উদাহরণে পরিণত হয়েছেন। এই নিষ্পাপতা আমরা সবাই হারিয়ে ফেলি যখন প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও অন্যায্য এক বিশ্বের ভয়াবহতার মধ্যে নিজেদের সত্তাকে নিয়ে প্রবেশ করি। ওই শতাব্দিতে অবদান রাখা বাকি সবাই আমাদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের মধ্যে নিজেদের অবস্থান দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। আর আলী আমাদের বিশ্বের কদর্যতম ঝড়ো সমুদ্রগুলোর মধ্যে অবগাহন করেছেন নিজের আত্মার পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রেখে। আমরা যে তার নাম ক্রমাগত সংক্ষিপ্ত করে গেছি তার কারণ আছে: ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র থেকে মোহাম্মদ আলী ক্লে। তা থেকে মোহাম্মদ আলী এবং সেখান থেকে আলী। এর কারণ হলো- আমাদের প্রয়োজন তাকে সৌভাগ্যকবচের আশ্বাসের মতো করে জড়িয়ে রাখা, তাকে নিজের ভেতরে ধারণ করা যেন যখন প্রয়োজন তখন তাকে সামনে আনতে পারি আর পুরো বিশ্বের সামনে তাকে ঠিক তার মতো করে উপস্থাপন করতে পারি। তার সত্তার মধ্যে, তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এবং তার সুন্দর মনের মধ্যে, তার কবিতার মধ্যে, বক্সিং রিংয়ে আলোড়নের মধ্যে আর রিংয়ের বাইরে তার সাবলীল বিদ্রোহী আচরণভঙ্গির মধ্যে- আমরা সেই নিষ্পাপতাকে দেখতে পাই যা এই বিশ্ব হারিয়ে ফেলেছে অতল গহ্বরে আর তা মরিয়া হয়ে খুঁজছে। মানবতার কাঠামোতে সব থেকে ভয়াবহ যেসব বিকৃতি হয়েছে তিনি তার বিরুদ্ধে লড়েছেন- ভণ্ডামি, বর্ণবাদ, বৈষম্য ও সমরবাদ। আর তিনি এসবের বিরুদ্ধে লড়েছেন সূক্ষ্ম রসবোধের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অভিজাত ক্রোধ দিয়ে। এমনকি যখন তিনি রিংয়ের মধ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘুসি মেরেছেন, তিনি সেটা করেছেন সাবলীলতা আর কাব্যের সঙ্গে। প্রতিপক্ষের জন্য রিংয়ের মধ্যে নেচেছেন ব্যালেরিনার মতো। তার জন্য গান গেয়েছেন গীতিকারের মতো। আর তারা বুঝে ওঠার আগেই ধরাশায়ী হয়েছেন আলীর বজ্রমুষ্টিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্বেষপূর্ণ বৈষম্য আর দাসত্বের পুরো ইতিহাসের গভীর থেকে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। আমেরিকান হওয়ার অর্থ কি তা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছেন। একদিকে ছিল সমরবাদ, বর্ণবাদ আর প্রভুত্ব স্থাপনের জগৎ আর অপরদিকে ছিলেন আলী। মার্কিনি হওয়ার অর্থ কি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। লড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকে তিনি বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন। হ্যাঁ, সে সময় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং ম্যালকম এক্স ছিলেন। কিন্তু আলীর তুলনায় তারা ছিলেন আঞ্চলিক নাম। আফ্রিকার কেন্দ্রবিন্দু থেকে লাতিন আমেরিকার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত, আরব আর মুসলিম বিশ্ব থেকে ইউরেশিয়ার মহাদেশীয় বিভাজন পর্যন্ত- প্রথমে তিনি তার ভক্তদের হৃদয় জয় করেছেন। এরপর যত্নশীল এক মালীর মতো ঠাঁয় অবস্থান নিয়েছেন। আর ওই হৃদয়গুলোতে বপন করেছেন ন্যায়বিচার আর ন্যায্যতার বীজ। আলীর মৃত্যু কোনো শূন্যতা রেখে যায় নি বরং সচেতনতার পুরো একটি পরিসরকে পূর্ণ করে দিয়ে গেছে যা দেখতে আর অনুভব করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তার আকস্মিক প্রয়ান ওই স্থানকে প্রজ্বলিত আর আন্দোলিত করেছে। হঠাৎ আমাদের মনে হয়েছে কেন আমরা তাকে ভালোবাসতাম। কিসের পক্ষে তার অবস্থান ছিল আর কিসের জন্য তিনি লড়েছিলেন। কেন আমাদের শোকসন্তপ্ত হতে হবে। জাতীয় দুর্দশা আর বৈশ্বিক হতাশার মৌসুমে তিনি জন্মেছিলেন। আর তিনি মারা গেলেন, ঘৃণ্য রাজনীতিবিদ ও সুযোগসন্ধানী কার্পেটব্যাগারদের (আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময়ে রাজনৈতিক ও আর্থিক লাভের আশায় যারা উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গিয়েছিল) মৌসুমে। এর মাঝের সময়টায় এ বিশ্বকে তিনি আশা, বিদ্রোহী আচরণ আর শক্তির সঙ্গে সত্য বলে অলঙ্কৃত করেছেন। নাগরিক অধিকারের নেতা, যুদ্ধবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট, হেভিওয়েট ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী এখন পরকালে পাড়ি দিয়েছেন। তার কঠোর অবস্থানের দৃষ্টান্তকে মুছে ফেলার লড়াই ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। শোকবার্তার আদলে এটা করা হচ্ছে। তার শক্তিশালী, অবিচল, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নজিরকে বিকৃত করা ও আপাতমধুর স্তুতিবাক্যে আড়াল করার প্রয়াস চলছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আজ্ঞাবহ আত্মাগুলো যারা না শুনে দমে যায় তাদের সামনে তাকে অপেক্ষাকৃত নমনীয় এক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা। কিন্তু তিনি যেমনটা ছিলেন, ঠিক সেভাবেই আমাদের তাকে মনে রাখতে হবে: একজন দারুণ পুরুষ, উত্তম আত্মা, অসাধারণ এক কবি, একজন নীতিনিষ্ঠ মুসলিম, একজন নাগরিক অধিকার আইকন, একজন অবিচল যুদ্ধবিরোধী নেতা, একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর একজন প্রিয়ভাজন আমেরিকান যিনি একাই মার্কিনি হওয়ার সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন। তার চমকপ্রদ স্মৃতি যেন চিরজীবন আমাদের চলার পথে আলো দিয়ে যায়। [হামিদ দাবাশি নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান স্টাডিজ অ্যান্ড কম্প্যারেটিভ লিটারেচার বিভাগের অধ্যাপক। উপরের লেখাটি আল জাজিরায় প্রকাশিত তার ‘হোয়াই উই মোর্ন আলী’ শীর্ষক লেখা থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন হাসনাইন মেহেদী। -ডেস্ক
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Notify me of follow-up comments by email.
Notify me of new posts by email.