দাওয়াতে প্রায় সবাই এসেছিলেন। গজারিয়ার নুরুজ্জামান, দাড়িয়াপুরের শামীম, হাতিবান্ধার নবীন চেয়ারম্যানরা কেউ বাদ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে হতেয়ায় পরিচয় সাদামাটা এক মানুষ বর্তমান উপজেলা বিএনপি সভাপতি খোরশেদ মাস্টার ইফতারের আগে এসে হাত ধরে বলেছিল, ‘স্যার, আমাদের দলীয় ইফতার আছে তাই থাকতে পারলাম না। দয়া করে মাফ করে দেবেন। আপনি ডেকেছিলেন আমি এসেছিলাম। অন্য দল করলেও এখনো আমরা আপনারই আছি। আপনার কল্যাণ কামনায় কখনো পিছপা হবো না। দোয়া করবেন বাচ্চারা সবাই লেখাপড়া করে মানুষ হতে চলেছে।’ কালিয়ার চেয়ারম্যান চশমা জামাল, কাকড়াজানের শামসু তাদের বিদেশ যাওয়ার কথা। ফোনে কথা হয়েছে। ৯ তারিখ সেহরি খেয়ে বিমানবন্দরের দিকে ছুটেছিল। তাই আসতে পারেনি। গজারিয়ার চেয়ারম্যান নুরুজ্জামানের অন্য অনুষ্ঠান ছিল। তাই আগে এসে দেখা করে গিয়েছিল। সখিপুরের প্রবীণ মানুষ আবুল হাজী, নয়া মুন্সী, কদ্দুস মেম্বার আরও অনেকে এসেছিল। মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ রেনুবর, কুতুবপুর কলেজের আবদুর রউফ, মুজিব কলেজের মানিক লাল ভৌমিক, বোয়ালী কলেজের সাঈদ আজাদ কেউ বাদ ছিল না। যাদের উৎসাহে আমার দলের নির্বাচনী প্রতীক গামছা হয়েছে তাদের একজন আলহাজ ফয়েজউদ্দিন অন্যজন আবদুল করিম মুন্সী। ফয়েজউদ্দিন হাজী অনেকদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। করিম মুন্সী হাজির হয়েছিলেন। বিশেষ করে বীর বিক্রম সবুর খান, আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম ও অধ্যাপক শামসুল হুদাকে দেখে মন ভরে গিয়েছিল। বীর বিক্রম আবদুস সবুর খানকে না পেলে আমি মুক্তিযুদ্ধে সফল হতে পারতাম কিনা এখন বলতে পারি না।
বেসামরিক এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে এনায়েত করিমের ভূমিকার কোনো তুলনা হয় না। আর শামসুল হুদা না হলে তথ্যের অভাবে ‘স্বাধীনতা ৭১’ লেখা হতো না। সাবেকদের মধ্যে তেমন কেউ বাদ ছিল না। যেমন মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের সাবেক ভিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জেলা সভাপতি আবদুল হাই মুক্তিযুদ্ধের সময় মানকারচর শরণার্থী শিবিরে ছিল। আগস্টের শেষে জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনের লোকজন এসেছিল মানকারচরে শরণার্থীদের খোঁজখবর নিতে। সেখানে আবদুল হাই হাজার হাজার শরণার্থী নিয়ে সে যে কী বিশাল বিক্ষোভ দেখিয়েছিল তা মুক্তিযুদ্ধের এক অখণ্ড ইতিহাস হয়ে আছে। সেই বিক্ষোভে রংপুরের এমপি সাদাকাত হোসেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিয়ের ঘটক সাবেক মন্ত্রী মতিয়ার রহমানও ছিলেন। জনাব কেফাতুল্লাহ তার জমি দেওয়ার কথা বয়ান করছিলেন। মা কুশিমনিকে আমরা বাড়িটি উপহার দিয়েছি। সে খুব মৃদুস্বরে মাইক্রোফোনে বলেছিল, ‘আপনারা এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন আমাকে বাড়ি দিয়েছে তাতে আমি খুশি। আমি সবাইকে ভালোবাসি। আপনারা আমাকে, আমার বাবা-মা-ভাই-বোনকে দোয়া করবেন।’ ডান পাশে মেয়র হানিফ, বাম পাশে কিতাব আলী, সামনে দাড়িয়াপুরের আবদুল হাই মাস্টারকে নিয়ে ইফতারে বসেছিলাম। মেয়র হানিফ ছোট্ট এক বাচ্চা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতে যোগদান করেছিল। আর যুদ্ধের শুরুতে পিলখানা থেকে পালিয়ে আসা ইপিআরদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল কিতাব আলী। দাড়িয়াপুরের জনাব আবদুল হাই এবং ইদ্রিস শিকদার ছিলেন আমার দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী। বন্ধু জয়নাল মওলানা অসুস্থ শরীরেও এসে মোনাজাত করেছেন। ইফতার মাহফিলের আয়োজনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতারা যে অসাধারণ সহযোগিতা করেছে তা বলার মতো নয়। বিশেষ করে জেলার সভাপতি আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম, উপজেলা সভাপতি আবদুল হালিম লাল, সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার শামীম, যুবনেতা হাবিবুন নবী সোহেল ও অন্যরা অত পরিশ্রম না করলে এমন সুন্দর ইফতার মাহফিল করা যেত না।
আজ তিন দিন বাড়ির পাশে পুরনো কোর্ট মসজিদে এতেকাফে আছি- এটা আমার জীবনের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৭০ দিন শান্তির দাবিতে ঘর ছাড়া। নেতানেত্রীরা না শুনুন আল্লাহ শুনলেই হলো। আর যদি সময় না পাই। এমনিতেই বাইরে আছি। মুসলমান হিসেবে এতেকাফটা এবার করে নেই। তাই লেখাটি তৈরি করেছি চার দিন আগে। যেদিন লেখাটি শেষ করি সেদিন অবস্থান কর্মসূচির ১৬৭তম দিন। এর আগে কোনো দিন শরীর খারাপ হয়নি। বাসাইল আসার আগে প্রচণ্ড হাচি কাশিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম। উঠেছিলাম জনাব আবদুস সাত্তার মিয়ার ছেলের বাড়ি আন্ধারী পাড়াতে। জনাব আবদুস সাত্তার মিয়া এক অসাধারণ সৌভাগ্যের অধিকারী মানুষ। ১৯৬০-৬২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তখনকার শেখ মুজিব কোনো মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে এই সাত্তার মিয়ার বাড়িতে উঠেছিলেন। তিন রাত ছিলেন। আবদুস সাত্তার মিয়ার স্ত্রী কাঞ্চনপুরের ২৩ বছরের চেয়ারম্যান ইসমাইল সরকারের মেয়ে নূরজাহান বেগম তাকে পরম যত্নে খাইয়েছিলেন। সেই সাত্তার মিয়ার বাড়িতে রাত কাটানো আমার জন্য এক পরম আনন্দের ব্যাপার। আবদুস সাত্তার মিয়ার চার ছেলে, চার মেয়ে- রেহেনা আক্তার, ফারজানা সুলতানা বন্যা, নাসরীন, ফরিদা; ছেলে- ইলিয়াস হোসেন, মো. শাহজাহান, শাহালম, এস এম পারভেজ বুলবুল এরা সবাই আমার জন্য পাগল। এদের মধ্যে ইলিয়াস ‘৭৫-এ দুষ্কৃতকারীদের হাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। তখন কেবল জেলা গভর্নর পদ্ধতি করা হয়েছিল। খবর পেয়ে বীর বিক্রম সবুর খানসহ ১০-১২টা গাড়ি নিয়ে আহত ইলিয়াসকে আনতে গিয়েছিলাম। সে বাঁচবে আশা ছিল না। কিন্তু আল্লাহর দয়ায় বেঁচেছিল অনেকদিন। টিপু, টিটুর বাবা শাহজাহান, বুলবুল এখনো আমাদের জন্য পাগল। তাই এতেকাফে বসার আগে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কী যে যত্ন করেছে বলতে পারব না। কত রকমের সুস্বাদু খাবার মনে রাখার মতো। বয়স হয়েছে তাও এরা বুঝতে চায় না। জোর করেই খাওয়াতে চায়। ওরা আমার দল করে বলে সরকারি দল কিভাবে যে নাজেহাল করার চেষ্টা করে তা লিখে বুঝাতে পারব না। কাল আবার লাউহাটি যেতে চাই। সেখানেই ইফতার করে রাত কাটাব।
শরীর যেমন কিছুটা অসুস্থ, তেমনি মনটাও খারাপ। কদিন আগে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। হজের বিরুদ্ধে কথা বলার অপবাদ তার মাথায়। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে কতবার অনুরোধ করেছি। তিনি কী করলেন বা করেছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। অন্যদিকে সৈয়দ আশরাফ অপমানিত-লাঞ্ছিত হয়ে দফতর হারিয়েছে। এখন দাপটে আছে বরিশালের মেয়ে শেরপুরের বউ বঙ্গবন্ধুর চামড়া, হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বাজানো মতিয়া চৌধুরী। বুঝতে পারছি না কী হতে চলেছে। এর মাঝেই আবার ময়মনসিংহে নেশা বিক্রেতা শাহীন কাপড় বিতরণের নামে মানুষ হত্যার যন্ত্র খুলেছে। টাকা হলেই তা দেখানো যায়? ফেতরা, জাকাত প্রচার করে বিলি করা শরিয়তে নিষেধ। কিন্তু শোনে কে? সরকারিভাবে বলছে নিহত ২৭ জন। সব লাশই কি পাওয়া গেছে? কেউ কি কাউকে বাড়ি নিয়ে কবর দেয়নি? যদি নিহত ২৭ হয় তাহলে আহত কত? পবিত্র মাহে রমজানের শেষের দিকে শান্তি স্বস্তি সব যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই মসজিদে বসে আল্লাহর কাছে শান্তি কামনা করছি তিনি যেন আমাদের শান্তি দেন, স্বস্তি দেন। এবারের ঈদ যেন সারা বিশ্বে অনাবিল শান্তি বয়ে আনে সেই প্রার্থনাই করি। দেশবাসীসহ পাঠকদের ঈদ মোবারক।
লেখক : রাজনীতিক।(ডেস্ক)